ফাহাদ ও মৎসকুমারীর গল্প(পর্ব ২)

                                        
রাত একটা বেজে কুড়ি মিনিট। সবাই হোটেলে ফিরে গেছে। বাহিরে কনকনে শীত। আর আছে শৈতপ্রবাহ। একটা সোয়েটার আর মাফলার নিয়ে রুম থেকে আস্তে করে বেরিয়ে এলো ফাহাদ। সবাই রুমে কম্বলের নীচে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন।
সী-বিচে কাউকে দেখতে পেলো না। শুধু কয়েকটা কুকুর একে অপরকে তাড়া করছে আর খেলছে। সি বীচে বসার জন্য কাঠের কিছু বেঞ্চ আছে। ফাহাদ একটা দেখে হাত দিয়ে একটু ঝাড়া দিয়ে বসল। ফাহাদকে দেখে কুকুরগুলো কয়েকবার হাঁক ছাড়ল। ফাহদের মন খারাপ হয়ে গেল। জীবনের ব্যর্থতার বোঝা থেকে নিষ্পত্তি পাওার ব্যপারে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল।
ফাহাদ আস্তে করে কূল ছেড়ে পানির দিকে এগিয়ে গেলো। পানি প্রচণ্ড ঠাণ্ডা। স্রোতের ঝাপ্টায় মুখে নোনা পানির স্বাদ পেল মুখে। জীবনের গ্লানি আর সহ্য হচ্ছে না। পারছেনা আর ব্যর্থতার লাগাম টেনে ধরতে। ভাবছে এই ভাবে পৃথিবীর বোঝা হয়ে থাকা আর ঠিক হচ্ছে না। ঠাণ্ডা পানিতে কোমর পর্যন্ত নেমে গেলো। আর অল্প একটু।তারপর সব ঠিকঠাক হয়ে যাবে। আব্বুর বকাও আর শুনতে হবে না। আম্মুর হাসি মুখটা মনে করে একটু মন খারাপ হল।কিন্তু আম্মুকে আর কষ্ট দেয়ার ইচ্ছে নেই ফাহাদের। ডুব দিতে যাচ্ছিল আর হঠাৎ কোথায় যেন শঙ্খ বেজে উঠলো। পীঠে ঠাশ করে কিছুর জোরালো আঘাত অনুভব করলো। আশেপাশে চেয়ে দেখলো কেউ নেই। ভাবলো মনে ভুল। কিন্তু এইবার কে যেন এই ছেলে বলে ডাক দিল। পিছনে ঘুরে যা দেখল ফাহাদের চক্ষু চড়কগাছ।এতো রাতে এক মেয়ে এই ঠাণ্ডা পানিতে। তবে মেয়ের দিকে তাকিয়ে একটু লজ্জা পেল ফাহাদ। কোমর পানিতে মেয়েটির পোশাক কিছুটা ছোটবেলায় কার্টুনে দেখা লিটাল মারমেইড এরিয়েলের মত। ফাহাদ রেগে গেল।
-এই মেয়ে!!!তুমি এতো রাতে এইখানে এই অবস্থায় এই খানে কি করছ? তোমার ভয় করে না। ছিঃ ছিঃ এই ভাবে মৎস্যকুমারীর মত কাপড় পরেছ কেন? যাও তাড়াতাড়ি,এতো রাতে কেউ সাতার কাটে? কেউ আমাদের দেখে ফেললে কি ভাববে? হায় হায়!!! যাও যাও!!!
খিল খিল করে হেসে উঠলো মেয়েটি। সেই হাসি কেমন যেন। 
-এই অবস্থায় দিনের বেলা সাঁতার কাটলে কি আর উপায় আছে!!! তুমি কি চোখে কম দেখ? আমার শরীরে তো কোন কাপড় নেই।
মেঘ সরে আকাশের চাঁদ উকি দিল। ফাহাদ দেখল আসলেই মেয়েটির উপরিভাগ অনাবৃত। মেয়েটি তার সন্দেহ দূর করার জন্য একবার পিছন ঘুরেও দেখালো। চাঁদের আলোতে মেয়েটির পানিতে ভেজা পিঠ চকচক করে উঠলো। মেয়েটির চুল খুবই কালো এবং ঘন। সেই ভেজা ঘন কালো চুল বক্ষদেশ আবৃত করার জন্য বুকের দুই দিকে সমান ভাবে ছড়ানো। ফাহাদের পাইরেটস অফ দ্যা ক্যারাবিয়ান মুভির মারমেইড দের কথা মনে পড়ল। তাদেরর মত করেই এই মেয়েটি সাঁজ সেজেছে। অস্পষ্ট আলোতে কালো চুলকে বক্ষবন্ধনী মনে হয়েছিল। নিশ্চয়ই মেয়েটি কোন বড় ঘরের পাগলী টাইপের মেয়ে। থাকে না যাদের মাথায় বিভিন্ন পাগলামি ভর করে। হয়ত মৎস্যকুমারী সাজার পাগলামি ভর করেছে।
-     তা তুমি এতো রাতে এখানে আসছো???তোমার আব্বু আম্মু জানে? তোমার ঠাণ্ডা লাগে না?? আমিতো সোয়েটার পরে এসেছিলাম। তোমার মাথা খারাপ নেই তো? এই ভাবে লজ্জা লাগে নি? আমি তো লজ্জায় তাকাতেই পারছি না।
-     নাহ।আমি তো পানিতেই থাকি। আবার খিল খিল করে হেসে উঠলো মেয়েটি। সেই হাসিতে কেমন যেন মায়া মায়া আছে। তুমি কি ভাবছো আমি মানুষ? আমি তো মানুষ না।
-     তোমার মাথা নিশ্চয়ই পুরাই গেছে। ফাজলামো কর। কেউ আমাদেরকে দেখার আগে এখান থেকে তাড়াতাড়ি উঠো।উনি নাকি মানুষ না। হুহ।
এইবার যা দেখল তা দেখার জন্য ফাহাদ প্রস্তুত ছিল না। মেয়েটি হাল্কা একটু কাত হয়ে তার শরীরের বাকী অংশটুকু দেখালো। চাঁদের আলোয় যা দেখল তা বিশ্বাস করার মত না। বাকীটুকু কে যেন একটা মাছের অর্ধেক থেকে কেটে জোড়া লাগিয়ে দিয়েছে বলে মনে হল। লেজ পর্যন্ত রূপালী আইশগুলো চাঁদের আলোতে চিক চিক করে উঠলো। আর রুই মাছের মত V আকৃতির লেজ নড়ছে অবিরত ভাবে। আমি ভুল দেখছি...আমি ভুল দেখছি বলে জ্ঞান হারলো ফাহাদ।
                                     
-এই ছেলে কি হল তোমার?
হঠাৎ নিজেকে সাগর পারে আবিস্কার করল ফাহাদ। আর দেখল পাশে দুই কনুই তে ভর দিয়ে তার পাশে আছে আধশোয়া এক মৎস্যকুমারী। তার শরীরের যে অর্ধেক মাছ সেইটুকু চলমান ঢেউয়ের মধ্যে ডুবানো। স্রোত না আসলে অংশটুকু দেখা যায়। আবার ঢেউ আসলে ডুবে যায়।
-     তুমি কি সত্যি না আমি স্বপ্নে দেখছি?
-     এই বাহানায় ছুঁয়ে দেখতে চাও নাকি? দেখ।আরেকবার লেজ দিয়ে বাড়ি দিব? আগের বারের ব্যাথা ভুলে গেছ? তুমি এতো রাতে পানিতে কি করতে এসেছিলে?
-     না না তার দরকার নেই।আর আমি ছুঁয়ে দেখতেও চাই না। পিঠের আঘাতের কথা মনে আছে ফাহাদের। আমরা কোথায় আছি এখন? আশে পাশের সব তো অচেনা লাগছে।
-     তুমি কিন্তু আমার প্রশ্নের উত্তর দাও নি। আমার সাগরের ঐপারে আছি। তুমি অজ্ঞান হওয়ায় তোমাকে কূলে নিয়ে এসেছি।
-     আমি এইখানে ডুবে যেতে এসেছিলাম। তোমার জন্য সেটা পণ্ড হয়ে গেলো।
-     কেন? কি সমস্যা তোমার? আমি তাই ভেবেছিলাম। তাই তাড়াতাড়ি চলে এলাম।
-     আমার জীবনের পালে ব্যর্থতার হওয়া লেগেছে। আমি আর সাফল্যের তীরে পৌছাতে পারবো বলে মনে হচ্ছে না। জীবনের যুদ্ধে আজ আমি পরাজিত। আমি আর পরাজয়ের গ্লানি মাথায় নিয়ে পরাজিত জীবনের এই কারাগারে বন্দী থাকতে পারবো না। আমি মৃত্যুতে মুক্তি পেতে চাই। মৃত্যু পারে আমাকে মুক্তি দিতে। যেখানে আব্বুর বকুনি থাকবে না। থাকবে না আম্মুর দুঃখমিশ্রিত হাসি মুখ।
-      তুমি কি সত্যি মারা দূরে চলে যেতে চাও? কেন পৃথিবীর মানুষদের মনে এত কষ্ট সেটা সৃষ্টিকর্তাই ভালো জানেন। তুমি জানো আমারও এইভাবে পানিতে জীবন কাটাতে ভালো লাগে না। অর্ধেক মানুষ আর অর্ধেক মাছ। ইস!!! এমন যদি হত আমি সম্পূর্ণ মানুষ হতে পারতাম!!! আর তুমি কিনা মানুষের এই সুন্দর জীবন ছেড়ে চলে যেতে চাচ্ছ। নিজের আবেগে চোখের কোণে জমে উঠা পানি চাঁদের আলোতে চিক চিক করে উঠল।
-     ছবিতে দেখেছিলাম তোমাদের চোখের পানির অনেক গুণ। আমাকে অমর করে দিতে পারবে।
-     তোমার লাগলে নিয়ে নাও। আমি তোমার আর আমার মধ্যে কোন তফাৎ দেখছি না। আমরা কেউই আমাদের জীবন নিয়ে সুখী না। নিয়ে নাও না। যদি তোমার লাগে।
-     না, না আমি অমর হতে চাই না। আমি তো এসেছিলাম মরার জন্য। অমর হয়ে বেঁচে থাকলে তো আমাকে আবার এই লাঞ্ছনা-বঞ্ছনা সহ্য করতেই হবে।
-     বাহ!!! এতো ভালো ছেলে তুমি। তা তোমার নামটাই তো জানলাম না। তোমার বয়েস ও তো খুব বেশি না।
-     নাম ফাহাদ। কিন্তু তুমিও তো আমার বয়সী বলেই মনে হচ্ছে। তোমার নাম কি? আমার নাম তো বললাম।
-     তোমাদের মত আমাদের নির্দিষ্ট কোন নামে নেই। আমারা সব্দের মাধ্যমে একে অপরের সাথে যোগাযোগ করি।আমাদের বয়স একটা পর্যায় পার হওয়ার পর আর বাড়ে না। আমরা চিরযৌবনের অধিকারী। আমার দুঃখ আমি কখনো বৃদ্ধা হব না। তুমি অনেক বেশি কথা বল। এতো কথা না বলে নিজের জীবন নিতে ভাবো। তুমি নাহলে আমার সাথে আমাদের রাজ্যে চল। তোমার তো এই মাটির পৃথিবী ভালো লাগে না। চল না হয় আমার সাথে পানির দেশে।
-     এর জন্য আমাকে কি করতে হবে। আমি তো সাঁতারও জানি না। আর পানিতে আমি কিভাবে থাকবো? আমি তো মাটির মানুষ।
-     তুমি বড্ড বেশি কথা বল ফাহাদ। তোমার মৃত্যুর চেয়ে আমাদের দেশে যাওয়াটা ভালো না? আমার হাত ধর। আমার সাথে চল আমাদের দেশে,তোমার সব দুঃখ শেষ হয়ে যাবে।
হঠাৎ দমকা ঠাণ্ডা বাতাস বইতে লাগলো। ঠাণ্ডায় আবারো শব্দ করে হাঁচি দিল ফাহাদ। 

Comments

Popular posts from this blog

স্মৃতি

মনের আকাশে মেঘ

এত তিতা লাগে কেন?